জীবনের হাতছানি

জীবনের হাতছানি
মূল কাহিনিঃ ন্যুট হ্যামসান (নোবেল ১৯২০) রচিত দ্য কল অফ লাইফ
অনুবাদঃ বৈশাখী ঠাকুর

কোপেনহেগেনের অভ্যন্তরীণ ডকের কাছেই একটা রাস্তা আছে— ভেস্টারভোল্ড। তুলনামূলকভাবে নতুন কিন্তু নির্জন, প্রশস্ত রাস্তা। এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় যদি বা কিছু ঘরবাড়ি—গ্যাস বাতি চোখে পরে কিন্তু মানুষজন নজরে আসে না মোটে। যদিও এখন গ্রীষ্মকাল তথাপি কাউকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় না।
যাইহোক, গতকাল সন্ধ্যায় ঐ রাস্তায় আমার সাথে একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে। সন্ধে নাগাদ দু-একবার ঐ রাস্তা দিয়ে পায়চারি করার পর দেখলাম এক মহিলা রাস্তার উল্টোদিক থেকে হেঁটে আসছেন। আশেপাশে আর কেউ ছিল না। গ্যাস বাতিগুলো জ্বললেও ভালই অন্ধকার ছিল। ঐ সামান্য আলোয় আমি ভদ্রমহিলার মুখটা দেখতে পেলাম না। আমার মতই হয়তো সন্ধ্যেবেলা হাঁটতে বেরিয়েছেন — এই ভেবে আমি পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। রাস্তার শেষে আবার ঘুরে ফিরে যাবার সময় দেখলাম সেই মহিলার পুনরাগমন। ফের সাক্ষাৎ। নির্ঘাত কারুর জন্য অপেক্ষা করছেন। ভাবনাটা মাথায় আসতে কৌতূহলটাও বেড়ে গেল — কার জন্য অপেক্ষা করছেন? আবার তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম। তৃতীয়বার যখন মুখোমুখি হলাম আমি টুপি খুলে সম্ভাষণ জানিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— শুভ সন্ধ্যা। কারুর জন্য অপেক্ষা করছেন কি?
ওনার অপ্রস্তুত হবার ভঙ্গী দেখে মনে হল তিনি অবশ্যই কারুর জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে কি উনি আপত্তি করবেন যদি এই অপেক্ষার সময়টুকু আমি ওনাকে সঙ্গ দিই! না! উনি আদপে আপত্তি জানালেন না। উল্টে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন আর বললেন ,
— আমি কারুর জন্যেই অপেক্ষা করছি না। একটু খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে বেরিয়েছি। এত দমবন্ধ লাগছিল ভেতরে।
পাশাপাশি দুজনে আমরা হাঁটতে লাগলাম। কথোপকথনে নানা বিষয় উঠে এল। আমি আমার হাত ধরার প্রস্তাব দিলাম।
— না, ধন্যবাদ। মহিলা মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন।
একটুও ভাল লাগছিল না আমার এইভাবে হাঁটতে। আমি তাকে একটুও দেখতেই পাচ্ছি না অন্ধকারে। আমি একটা দেশলাই জ্বালালাম যেন সময়টা দেখতে চাই। দেশলাই কাঠি প্রজ্বলিত করে তার মুখের দিকে ফিরে তাকালাম।
— সারে নটা। আমি বললাম।
তিনি কাঁপছিলেন যেন জমে যাচ্ছিলেন। আমি সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম।
—আপনি তো জমে যাচ্ছেন! আমরা কি কোন সরাইখানায় ঢুকে কিছু পান করতে পারি? টিভওলি না ন্যাশনালে?
— কিন্তু আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে আমি এখন কোথাও যেতে পারব না।
এই প্রথম আমি খেয়াল করলাম যে মহিলার মুখের ওপর বোরখার মত একটা বড় কালো কাপড় রয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ ক্ষমা চেয়ে নিলাম এবং যেভাবে উনি আমাকে ক্ষমা করে দিলেন তাতে বুঝলাম যে তিনি নিত্যদিনের নৈশচারিণীদের মত নন।
— আপনি আমার হাতটা ধরতে পারেন। হয়তো একটু উষ্ণতা খুঁজে পাবেন।
অতঃপর তিনি আমার বাহু ধরলেন। আমরা আরও কয়েকবার একই রাস্তা দিয়ে হাঁটলাম। তিনি আবারও সময় জানতে চাইলেন।
— দশটা বাজে। কোথায় থাকেন আপনি?
— গ্যামলে কঞ্জেভেইতে।
—তাহলে চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
—না না আপনার আসাটা ঠিক হবে না। আপনি তো বেলগ্রেডে থাকেন, তাই না!
—আপনি কি করে জানলেন? আমি হতবাক!
—আমি জানি আপনি কে।
খানিক নীরবতার পর আবার আমরা বাহুতে বাহু গলিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। এবার উনি বেশ জোরে জোরে হাঁটতে লাগলেন।
— এবার আমায় যেতে হবে।
গ্যামলে কঞ্জেভেই—এর দোরগোড়ায় যখন পৌঁছলাম উনি আন্তরিকভাবে আমাকে ধন্যবাদ জানালেন ওনাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবার জন্য। আমি গেটটা খুলে দিলাম। উনি ধীর পায়ে ঢুকে গেলেন। কৌতূহলবশতঃ আমিও নিজের শরীরটাকে গেটের ভেতর ঢুকিয়ে ওনার পেছন পেছন ঢুকলাম। একবার ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পর উনি খপাত করে আমার হাতটা ধরলেন। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে নীরব রইলাম।
অতঃপর আমরা সিঁড়ি ভেঙে দুটো তলা পেরিয়ে তিনতলায় এসে উপস্থিত হয়েছি। সে নিজেই তালা খুলে নিজের ঘরে ঢুকল। তারপর দ্বিতীয় তালাটা খুলল। আমার হাতটা ধরে ভেতরে নিয়ে এল। বোধ করি সেটা ওদের ড্রয়িং রুম হবে। আমি দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। মহিলা ঘরে ঢুকে একটু সময় নিল ধাতস্থ হবার জন্য। তারপর আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তীব্র আবেগে অশ্লেষে আমার মুখে চুম্বন খেল। সোজাসুজি ওষ্ঠে।
— আপনি বসবেন না? এই তো এখানে সোফা রয়েছে। আপনি বসুন। আমি একটু আলোর ব্যাবস্থা করি।
সে বাতি নিয়ে এল।
আমার চারিপাশে চোখ বোলালাম। আমি বিস্মিত হয়ে নিজেকে পেলাম একটা বেশ বড় ঘরে। আধুনিক আসবাবপত্রে সুসজ্জিত ঘরটির দরজা দিয়ে আরো অনেক ঘরে যাওয়া যায়। আমি দেখে বুঝতে পারছিলাম উল্টোদিকে আরও অনেক ঘর রয়েছে। আমি জীবনে কখনও এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। আমি ধরতেই পারছিলাম না যে আমি এই মুহূর্তে যে মানুষের সাহচর্য উপভোগ করছি সে ঠিক কি ধরণের মানুষ!
— কি সুন্দর ঘর! আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম। তুমি থাক এখানে?
—হ্যাঁ। এইটা আমার বাড়ি।
—ও এইটা তোমার বাড়ি! তুমি তোমার বাবা-মায়ের সাথে এখানে থাক?
—আরে না! সে হেসে উঠল। আমি একজন বয়স্কা মহিলা যেটা তুমি এখন দেখতে পারবে। সে তার মুখের ওপর থেকে আভরণটা সরিয়ে দিল।
— এই যে দেখতে পাচ্ছ তো! কি বলেছিলাম আমি তোমাকে। বলেই সে নিজেকে আবার ছেড়ে দিল আমার ওপর কি এক উদগ্র কামনার বশে।
ওর বয়স বড় জোর বাইশ কি তেইশ হবে। ডান হাতের আঙ্গুলে একটা আংটি ছিল। বিবাহিতা সেটা স্পষ্ট। সুন্দরী ছিল কি? না মুখ ভর্তি মেচেদা ছিল তার। ভুরু বলতে কিছু ছিল না। কিন্তু অদ্ভুত এক প্রানশক্তি ছিল তার মধ্যে আর তার ঠোঁটটা ছিল ভারী সুন্দর—মাদকতাময়।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম — সে কে? তার স্বামীই বা কোথায় যদি থেকে থাকে? আর এটাই বা কার বাড়ি যেখানে সে আমায় নিয়ে এসেছে। যতবার আমার এই প্রশ্ন গুলো মনে আসে—তাকে করতে যাই –সঙ্গে সঙ্গে সে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পরে ওষ্ঠে ওষ্ঠ চেপে ধরে যাতে আমি কোন প্রশ্ন না করতে পারি। তারপর খানিক বাদে নিজেই বলল,
—- আমার নাম এলেন। তুমি কি কিছু পান করবে? কেউ বিরক্ত হবে না আমি যদি ফোন করে আনাই। ততক্ষণে তুমি বরঞ্চ এদিকের ঘরটায় এস —আমাদের বেডরুমে। আমি তাঁদের শোওয়ার ঘরে ঢুকলাম। ড্রয়িং রুম থেকে যে আলোটা আসছিল সেটাতেই মোটামুটি আলোকিত হয়ে উঠল শোওয়ার ঘরটা। আমি দুটো বিছানা দেখতে পেলাম। এলেন ফোন করে ওয়াইন অর্ডার করল। আমি শুনতে পেলাম এক পরিচারিকা বেল বাজিয়ে ওয়াইন দিয়ে গেল এবং বেরিয়েও গেল। একটু বাদে এলেন বেড রুমে এল। আমি তার দিকে এক পা এগোলাম। সে উচ্ছ্বাসে মৃদু একটা আওয়াজ করল। তারপর আমার দিকে এগিয়ে এল। এটাই ছিল আমাদের শেষ সন্ধে।
তারপর কি হল? ধৈর্য হরুন পাঠক। ধৈর্য ধরুন। আরও অনেক বাকি আছে!
পূব আকাশ ফর্সা হয়ে উঠেছে যখন ঘুম ভাঙল। পর্দা ভেদ করে সূর্যের আলো সারা বিছানায় এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। এলেনেরও ঘুম ভেঙেছে। সে আমার দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসল। তার হাত দুটো সাদা ভেলভেটের মত মনে হচ্ছিল। বক্ষদ্বয় একটু বেশীই উঁচু লাগছিল। আমি ওর কানে ফিসফিস করলাম। আবার সে আমার মুখ বন্ধ করে দিল নিজের মুখ এনে। দিনের আলোর তীব্রতা বাড়তে লাগল।
দু ঘণ্টা বাদে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। এলেনও উঠে বসে ব্যস্ত হয়ে পড়ল জামাকাপড় পরতে। সে পায়ে জুতোও গলিয়ে নিল। এরপর আমার যা অভিজ্ঞতা হল তা মনে করলে আজও মনে হয় কোন দুঃস্বপ্ন বুঝিবা! আমি মুখ হাত ধোওয়ার জন্য বেসিনে গেলাম। এলেনের কোন কাজ থেকে থাকবে হয়তো তাই তার পাশের ঘরে যাবার প্রয়োজন হয়ে পরেছিল। সে দরজা ঠেলে যখন পাশের ঘরটায় ঢুকতে গেল আমি মাথা ঘুড়িয়ে তাকালাম। একটা ঠাণ্ডা শীতল হাওয়া যেন ঘরটা থেকে বেড়িয়ে মুখেচোখে ঝাপটা মারল আর আমি চেয়ে দেখলাম ঘরটার মধ্যিখানে একটা টেবিলের ওপর একটি মৃতদেহ শুয়ে আছে। একটি শব কফিনের ভেতর সাদা পোশাক পরিহিত। রক্তশূন্য মুখে ধূসর দাড়ি ছিল ভদ্রলোকের। ওনার কৃশকায় হাটুঁ যেন মুষ্টিবদ্ধ হাতের মত উঁচু হয়ে কেবল সাদা কাপড় ঠেলে বেড়িয়ে আসতে চাইছিল। আমি সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম দিনের আলোতে। কিন্তু আমি একটা শব্দও মুখ দিয়ে বার না করে চুপচাপ মুখ ঘুড়িয়ে নিলাম।
এলেন যখন পুনরায় সেই ঘর থেকে বেরোল আমি জামা প্যান্ট পরে পুরোদস্তুর বেড়িয়ে যাবার জন্য রেডি। তার আলিঙ্গনের প্রতিক্রিয়ায় আর সেই উষ্ণতার সাথে কাছে টেনে নিতে পারলাম না। সে ওপরে আরও কিছু জামা কাপড় চড়াল কারণ সেও বেরিয়ে আমাকে একদম রাস্তা অবধি এগিয়ে দিতে চায়। কোন উচ্চবাচ্য না করে সম্মতি জানালাম। দরজার কাছে এসে সে ফিসফিস করল আমার কানে,—তাহলে বিদায় বন্ধু।
—কাল পর্যন্ত! আমি ইচ্ছে করেই কথাগুলো বললাম তাকে পরীক্ষা করার জন্য।
— না, কালকে নয়।
— কেন? কালকে নয় কেন?
— অত প্রশ্ন কর না সোনা। কাল আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। আমার এক নিকট আত্মীয়ের মৃত্যু ঘটেছে। দেখ তোমাকে সত্যি কথাটা বলেই দিলাম।
— তাহলে তার পরের দিন মানে পরশু?
— হ্যাঁ পরশু দিন আমাদের আবার দেখা হবে ঠিক এখানে। এই দরজার সামনেই। আমি চলে গেলাম। মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। কে ছিল সে? আর ঐ লাশটা? হাঁটু বেড়িয়ে পড়ছে – সাদা কাপড় ভেদ করে আর ঐ রক্তশূন্য মুখটা! পরশুদিন সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমার কি ওর সাথে আবার সাক্ষাৎ করা ঠিক হবে? আমি সোজা বারনিনা ক্যাফেতে চলে গেলাম আর ডিরেক্টারির খোঁজ করলাম। গ্যামলে কঞ্জেভেই – এর ঠিকানা দিয়ে নম্বর খুঁজলাম এবং অচিরেই নামটা খুঁজে পেলাম। আমি আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলাম যতক্ষন না সেদিনের খবরের কাগজ ক্যাফেতে আসে। সংবাদপত্র হাতে আসতেই আমি মৃত্যুসংবাদের পাতায় চলে গেলাম সটানে। সেখানে খুঁজতে খুঁজতে ওর সংবাদটা আমি পেয়ে গেলাম।
“ আমার স্বামী, ৫৩ বছর বয়স দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর আজ পরলোক গমন করেছেন। ওনার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি। “
তারিখটা আগের দিনের দেওয়া ছিল।
আমি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম আর ভাবলাম।
একটি লোক বিয়ে করল। তার স্ত্রী তার থেকে তিরিশ বছরের ছোট। তারপর সে একটি মারণব্যাধিতে আক্রান্ত হল। অবশেষে একদিন সে ইহলোক ত্যাগ করল।
আর… আর… তার যুবতী বিধবা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল…!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *